ইউরোপে যেভাবে প্রাণ হারাচ্ছেন বাংলাদেশীরা
- ফয়সল মাহমুদ স্পেন থেকে ফিরে
- ২৮ অক্টোবর ২০১৮, ১২:০১
ভাগ্য বদলানোর আশায় অবৈধভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবেশের চেষ্টাকালে প্রাণ হারাচ্ছেন বাংলাদেশীরা। আফ্রিকা ও আরবের বিভিন্ন দেশ থেকে তুরস্ক কিংবা গ্রিসে নৌপথে লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর কিংবা আটলান্টিক মহাসাগর স্পিড বোড কিংবা ট্রলার দিয়ে পাড়ি জমানোর সময় সলিল সমাধি হচ্ছে অনুপ্রবেশকারীদের। আবার আফ্রিকার দেশ মৌরিতানিয়া রুটে সাহারা মরুভূমি হয়ে পর্তুগাল ঢোকার চেষ্টাকালে সাহারা মরুভূমির দুর্গম পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অনাহারে অনেকে মৃত্যুরকোলে ঢলে পড়েন। এর মধ্যে অনেকে অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টাকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন। আবার দালালের খপ্পরে পড়ে অনেকে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। মুক্তির জন্য দেশ থেকে ভিটেমাটি বিক্রি করে টাকা পয়সা দিয়েও মিলছে না তাদের মুক্তি। বর্তমানে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টায় লিবিয়ার কারাগারে ২৮০ জন বাংলাদেশী নাগরিক বন্দী রয়েছেন। লিবিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্টদূত শেখ সেকান্দর আলী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বিষয়টি জানিয়েছেন।
ইউরোপের অন্যতম প্রবেশদ্বার স্পেন সফর করে দালালদের মাধ্যমে স্পেনে যারা এসেছেন তাদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, বর্তমানে মানব পাচারকারী দালাল চক্র ইউরোপে ঢোকার জন্য যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়াকে নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। দালালদের মাধ্যমে আসা বেশির ভাগ বাংলাদেশী চেষ্টা করেন লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে তুরস্ক হয়ে ইউরোপের দেশ গ্রিস কিংবা ইতালিতে প্রবেশের। লিবিয়া থেকে দালালের মাধ্যমে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকে প্রাণ হারাচ্ছেন। লিবিয়া থেকে দালালরা স্পিড বোটে তুরস্ক কিংবা গ্রিসে মানবপাচারের চেষ্টা করে থাকে।
লিবিয়া হয়ে গ্রিসে আসা আফজাল জানান, রাতে দালালেরা একটি স্পিড বোটে ২০ জন যাত্রী দিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে গ্রিসে তাদের প্রবেশ করায়। অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে ভূমধ্যসাগরের মধ্যে স্পিড বোডটি গ্রিসের দিকে ছুটতে থাকে। গভীর রাতে সাগরের উত্তাল গর্জন আর বর্ডার গার্ডদের চোখ রাঙানি সব মিলিয়ে তিন ঘণ্টার নৌপথটি আমার কাছে একটি বিভীষিকাময় রাত ছিল। স্পিড বোটটি যখন মধ্যসাগরে অবস্থান করছিল তখন ঝড়ের কবলে পড়ে। প্রচণ্ড ঝড়ে অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই স্পিড বোটটি বারবার সাগরের পানির মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে আবার কখনো সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে উঠে যাচ্ছে প্রায় ২০ থেকে ৩০ ফুট উপরে। আমরা সবাই কলেমা পড়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলাম। এর কিছুক্ষণ পর ঝড় থামলে আমাদের স্পিড বোডটি ঝড়ে গন্তব্য হারিয়ে বর্ডার গার্ডের হাতে ধরা পড়ে। আমরা লিবিয়ার কারাগারে বন্দী জীবনযাপন করি পাঁচ মাস।
দালালদের মাধ্যমে স্পেনে আসা সিলেটের ইমরান জানান, তিনি যে স্পিড বোট দিয়ে লিবিয়া থেকে তুরস্ক এসেছিলেন সেই স্পিড বোটের ১৯ জন যাত্রীর মধ্যে দু’জন স্পিড বোটে মারা যান। তাদের বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জ ও কানাইঘাটে। তিনি বলেন, ভূমধ্যসাগরে লিবিয়া থেকে যখন স্পিড বোটটি যাত্রা শুরু করে তখন রাতের আঁধারে তুরস্ক পৌঁছানোর চেষ্টা থাকে। তাই প্রচণ্ড স্পিডে স্পিড বোটটি চলতে থাকে। কিন্তু আমাদের স্পিড বোটটি তুরস্কের কাছাকাছি আসতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেখে আচমকা গতি থামায়। ফলে প্রায় চার ঘণ্টা সময় ধরে প্রচণ্ড গতিতে চলতে থাকা স্পিড বোটটির যাত্রীদের মধ্যে বমি শুরু হয়। এর মধ্যে দু’জনের অবস্থা বেগতিক হলে তাদের স্পিড বোটে মৃত্যু হয়। সবচেয়ে কষ্টদায়ক ছিল বাংলাদেশী মৃত দু’জনের লাশ দালালরা ভূমধ্যসাগরে নিক্ষেপের দৃশ্য দেখে। আমরা প্রতিবাদ করলে দালালেরা জানায় বেশি চেঁচামেচি করলে সবাই গ্রেফতার হয়ে জেল খাটতে হবে। তাই আর কেউ প্রতিবাদ করেনি।
ইউরোপে ঢোকার আরেক পথ হলো আলজেরিয়া থেকে মৌরিতানিয়া হয়ে সাহারা মরুভূমির পর মরক্কো হয়ে পর্তুগাল। এই রুটের সবচেয়ে ভয়ানক প্রান্তর হলো সাহারা মরুভূমি। এই সাহারা মরুভূমি হেঁটে পাড়ি দিতে হয়। সাহারা মরুভূমি হেঁটে পাড়ি দিতে প্রায় এক সপ্তাহ লেগে যায়। এক সপ্তাহ হাঁটার পথে পানাহারের জন্য দু’বোতল পানি ছাড়া আর কিছু বহন করতে দালাল চক্র নিরাপদ মনে করে না। দালালেরা যাত্রীদের তাড়াতাড়ি পথ পাড়ি দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। সাহারা মরুভূমিতে যখন যাত্রীরা রওনা হয় তখন তাদের অনুসরণ করতে থাকে দালালরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে চলতে থাকে দুর্গম পথ পাড়ি দেয়ার প্রয়াস। অনেক সময় এই পথ এক সপ্তাহে শেষ হয় আবার পথে ঝামেলা হলে দেরি হয়। যাত্রাপথে পানি শেষ হলে শুরু হয় যাত্রীদের আর্তনাদ। প্রচণ্ড গরম আর তৃষ্ণার্ত প্রাণ খাদ্যের জন্য হাহাকার করতে করতে শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করে। আর যারা সাহারা মরুভূমি পাড়ি দিতে পারেন তারা মরক্কোতে পৌঁছান। সেখানে শুরু হয় দিন গোনা, কবে ঢুকতে পারবেন পর্তুগাল কিংবা স্পেনে।
এ দিকে দালালদের মাধ্যমে যারা ইউরোপে ঢুকতে পেরেছেন, তাদের মাথা গোঁজার জন্য জীবনযুদ্ধে নামতে হয়। প্রথমে তাদের বাসস্থানের জন্য পরিচিত জনদের কাছে ধরনা দিতে হয়। বাসস্থানের পর কাজের জন্য মিথ্যে চেষ্টা। ইউরোপের কোনো দেশ যেমনÑ স্পেন, ফ্রান্স ইতালি কিংবা পর্তুগালে পারমিট ছাড়া কাজ পাওয়া সম্ভব নয়। যারা অ্যাসাইলাম কিংবা হিউম্যান রাইটসে থাকার জন্য আবেদন করেন তাদের আবেদন বিবেচনা কিংবা আমলে নিতে প্রায় ৮ মাস লেগে যায়। কোনো কোনো দেশে আরো বেশি সময় লাগে। আবেদন গ্রহণের আগ পর্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। আবেদন গৃহীত হলে কিছু ভাতা পাওয়া যায়; যা দিয়ে হাত খরচ চলে। কিন্তু কাজের পারমিট পাওয়ায় আগ পর্যন্ত অনেকে রাস্তায় ফুল, ঘড়ি বিক্রি কিংবা লিফলেট বিতরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। আবার যারা ইউরোপের কোনো দেশের কাগজ পেয়ে যান তাদের জন্য সমস্ত ইউরোপ উন্মুক্ত ( ইংল্যান্ড ছাড়া)।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া ইউরোপ পর্যন্ত দালালদের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। তারা বিশেষ করে প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট অঞ্চলে বেশি সক্রিয়। প্রতারণার মাধ্যমে তারা মানবপ্রাচারে জড়িত। তাদের প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকে ইউরোপে পাড়ি দিতে গিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। আবার কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে কারাগারে বন্দী জীবনযাপন করছেন।
দালালদের হাতে প্রতারিত হয়ে দীর্ঘ পাঁচ মাসে স্পেনে আসা সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার সুমন জানান, দালালেরা আমার সাথে চুক্তি করে এক মাসের মধ্যে ৮ লাখ টাকায় স্পেনে পৌঁছানোর। তারা আমাকে বলে লিবিয়া হয়ে খাল পাড়ি দিয়ে তুরস্ক হয়ে তারা আমাকে স্পেনে পৌঁছে দেবে। সেই জন্য মধ্যস্থতাকারীর কাছে অগ্রিম ৮ লাখ টাকা রাখা হয়। লিবিয়া আসার পর দালালেরা সেই ৮ লাখ টাকা মধ্যস্থকারীর কাছ থেকে তুলে নেয়।
পরে আমাকে বিপদে রেখে তারা আমার পরিবারের কাছে আরো চার লাখ টাকা দাবি করে। পরিবার বাধ্য হয়ে দালালদের হাতে আরো চার লাখ টাকা তুলে দেয়। এর পরেও দালালেরা আমাকে লিবিয়ায় প্রায় চার মাস অনাহারে-অধাহারে রাখে। আমি দালালদের কাছে আমাকে স্পেন পৌঁছানোর তাগিদ দিলে তারা আমার সাথে নানা টালবাহানা করে। পরে তারা আমাকে চার দফা চেষ্টার পর স্পিড বোটে ভূমধ্যসাগর নৌপথে তুরস্কে পৌঁছায়। অথচ তারা আমাকে বলেছিল লিবিয়া থেকে একটি খাল পাড়ি দিয়ে তুরস্ক ঢোকে সেখান থেকে আমাকে স্পেনে পৌঁছে দেবে। তিনি জানান, সাগর যাদের কাছে খাল মনে হয় সেই দালালদের খপ্পরে পড়ে অনেকে খাল নামক সাগরে প্রাণ হারাচ্ছেন।
বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০১৫ সাল থেকে লিবিয়ায় বাংলাদেশী জনশক্তি রফতানি বন্ধ; কিন্তু বর্তমানে লিবিয়া হয়ে ইউরোপের যাওয়ার চেষ্টাকালে ২৮০ জন বাংলাদেশী নাগরিক লিবিয়ার কারাগারে বন্দী রয়েছেন। তারা চলতি বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সুদান, মিসর, আলজেরিয়া, মৌরিতানিয়া, মরক্কো থেকে লিবিয়ায় সাগর পাড়ি দেয়ার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। গ্রেফতারকৃত কারো কাছে লিবিয়ার ভিসা ছিল না।
সার্বিক বিষয়ে স্পেনে অবৈধ অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন বালিয়েন তো বাংলার সভাপতি ফজলে এলাহি বলেন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে ঢোকার জন্য দালালেরা স্পেনকে বেছে নেয়। ফলে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে অনেকে গ্রেফতার হয়ে বন্দী জীবন কাটাচ্ছেন। আমি দাললদের মিথ্যে আশ^াসে অবৈধ পথে না এসে সেনজিন ভিসা নিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। আশার কথা আগামীতে স্পেনে এগ্রিকালচার ভিসা চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সাগর পথে আসতে গিয়ে আপনারা বিপদে পড়বেন না।